সুনামগঞ্জ , সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫ , ১৫ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
পাকিস্তানে আত্মঘাতী হামলায় ১৬ সেনা নিহত টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষায় কাজ করবে সরকার: মহাপরিচালক শহরে সক্রিয় মাদক কারবারিরা চোখের সামনে বিলীন হচ্ছে ভিটেমাটি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রতিবাদে মানববন্ধন অ্যাড. নুরুল ইসলামকে ফতেপুর বিএনপি নেতাকর্মীদের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন আধিপত্য নিয়ে লড়াইয়ের অবসান চান গ্রামবাসী কাজ না করেই তিন প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ সুনামগঞ্জকে শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের শহর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে সুনামগঞ্জ-৫ আসনে আলোচনায় বিএনপি’র দুই হেভিওয়েট প্রার্থী কৃষকরা বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রেখেছেন : অতিরিক্ত কৃষি সচিব নদী ভাঙন রোধের দাবিতে ভাদেরটেক গ্রামবাসীর মানববন্ধন গ্যাসের পাইপ লাইনে লিকেজ, দুর্ঘটনার আশঙ্কা জামালগঞ্জে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত বিএনপি নেতা অ্যাড. নূরুল ইসলামের গণসংযোগ ভক্তি আর সম্প্রীতিতে মুখরিত রথযাত্রা চাঁদা না দেয়ায় দুই ভাইকে ছুরিকাঘাত : একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক মাছ বাজারে প্রতারণার ফাঁদে ক্রেতারা বালুপাথর মহালের ইজারা বন্ধ নয়, ইজারা প্রথার বাতিল চাই ১১ মাসে অর্ধ শত কোটি টাকার বালু লুট

সুনামগঞ্জে বজ্রপাত আতঙ্ক: দশ বছরে মৃত্যু দেড় শতাধিক

  • আপলোড সময় : ৩০-০৪-২০২৫ ১১:৪৪:৩২ অপরাহ্ন
  • আপডেট সময় : ০১-০৫-২০২৫ ১২:০৪:৫০ পূর্বাহ্ন
সুনামগঞ্জে বজ্রপাত আতঙ্ক: দশ বছরে মৃত্যু দেড় শতাধিক
বিশেষ প্রতিনিধি ::
দেশে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় হাওর অধ্যুষিত জেলা সুনামগঞ্জে। হাওরাঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষই বেশি শিকার হচ্ছে প্রাকৃতিক এ দুর্যোগের।
আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকা- এবং অসচেতনতার কারণে দিন দিন বাড়ছে এই আতঙ্ক। এ জন্য সচেতনতার বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
এছাড়া বজ্র নিরোধক দন্ড স্থাপনের পাশাপাশি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের দাবিও জানিয়েছেন কেউ কেউ। জানা যায়, চলতি প্রাক-বর্ষা মৌসুমে (মার্চ-মে) সুনামগঞ্জে এখন পর্যন্ত ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে দিরাইয়ে দুইজন, শাল্লায় একজন, শান্তিগঞ্জে একজন, ছাতকে একজন ও দোয়ারাবাজারে একজন।
গেল বছর সুনামগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতে ১১ জন ও ২০২৩ সালে ১২ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া ২০১৫-২০২২ সাল পর্যন্ত ৮ বছরে বজ্রপাতে ১৪০ জন মারা গেছে এ জেলায়।
হিলিয়ান জার্নালে প্রকাশিত ‘জিআইএস-বেজড স্পেশাল অ্যানালাইসিস ফর লাইটিনিং সিনারিও ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বজ্রবৃষ্টি ও কালবৈশাখী ঝড় বেশি হয় মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত। এর মধ্যে মার্চ মাসে গড়ে ৬ দিন, এপ্রিল মাসে ৯ দিন এবং মে মাসে গড়ে ১৩ দিন হালকা, মাঝারি ও তীব্র মাত্রার বজ্রবৃষ্টি হয়। যার বেশির ভাগই সুনামগঞ্জে হয়ে থাকে।

হাওরাঞ্চলের মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, বজ্রপাতে বেশি মারা যায় কৃষক ও জেলে। চৈত্র থেকে আষাঢ় (মার্চ-মে) মাস পর্যন্ত কালবৈশাখী ঝড়ের সাথে খুব বজ্রবৃষ্টি হয়।
এ সময় বোরো ফসল ঘরে তুলতে দিনরাত হাওরেই পড়ে থাকতে হয় কৃষকের। এরপর জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষদিকে গোটা হাওরাঞ্চল পানিতে তলিয়ে যায়। তখন ওই এলাকার বৃহৎ জনগোষ্ঠীর একটা অংশ জীবিকার তাগিদে মাছ ধরতে হাওরে বের হয়। এ মুহূর্তে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে বিশাল হাওর পাড়ি দিয়ে দ্রুত কৃষক-জেলে কেউই নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরতে পারে না। যে কারণে বজ্রপাতের শিকার হয়ে মারা যায় অনেকে। বজ্রপাতসহ প্রকৃতিগত যেকোন দুর্যোগ মোকাবেলায় হাওরের প্রতিটি স্পটে জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপনের তাগিদ অনেকের।

বজ্রপাত থেকে বাঁচার উপায় : সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজিব হোসাইন বজ্রপাত থেকে জীবন রক্ষায় করণীয় বিষয়ে বলেন, টেকনোলজি কিংবা প্রযুক্তির বাইরে গিয়ে কিভাবে বজ্র ঝুঁকি কমানো যায় সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। পশ্চিম আকাশে মেঘের রঙ কালো দেখলেই মাঠে-ঘাটে থাকা যাবে না। এই শর্তটা সকলকে মানতে হবে। আপনার জীবন আপনাকে বাঁচাতে হবে। বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সচেতনতার বিকল্প নেই। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে থাকা নির্দেশনা দেখেও সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন এই আবহাওয়াবিদ।
বিশেষ করে কৃষক ও মৎস্যজীবীদের জন্য তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, যারা মাঠে থাকবেন তারা পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে নিচু হয়ে কানে হাত দিয়ে বসে থাকবেন। আর যারা নৌকায় থাকবেন তারা অবশ্যই বজ্রপাতের আশঙ্কা দেখা দিলে দ্রুত নৌকার ছাউনির (ছই) ভেতরে অবস্থান নেবেন।
আবহাওয়া পূর্বাভাস সম্পর্কে তিনি জানিয়েছেন, সামনের দিনগুলোতে আবহাওয়ার পূর্বাভাস একই রকম থাকবে। এই রোদ, এই বৃষ্টি, আবার ঘূর্ণিঝড়। খুব বেশি পরিবর্তন হবে না।

একই রকম পরামর্শ দিয়েছেন পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাশমির রেজা। তিনি বলেন, ভৌগোলিক কারণে হাওর এলাকায় বজ্রপাত বেশি হয়। খাসিয়া, জৈন্তিয়া ও মেঘালয় পাহাড়ে মার্চ-মে মাসজুড়ে মেঘ জমে থাকে। মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে পাহাড়ি পাদদেশ সুনামগঞ্জে বজ্রপাত আতঙ্ক বেশি। বজ্রপাত থেকে জীবন বাঁচানোর কৌশল হিসেবে তিনি বলেন, বজ্রপাত উঁচু গাছপালা কিংবা উঁচু স্থানে প্রথম আঘাত হানে। তাই গাছের নিচে থাকা ঠিক হবে না। খোলা জানালা, খোলা বারান্দা থেকে দূরে থাকাটা নিরাপদ। বজ্রপাতের সময় ইলেক্ট্রনিক জিনিস ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সচেতনতার তাগিদ দিয়ে তিনি আরও বলেন, নির্দিষ্ট দূরত্বে বজ্র নিরোধক দন্ড স্থাপনের পাশাপাশি দুর্গম হাওরে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ জরুরি। এছাড়া হাওরাঞ্চলে জলসহিষ্ণু গাছ রোপণ করতে হবে। সুনামগঞ্জ প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত জেলা হলেও সেখানে আবহাওয়া অধিদপ্তর নেই। আবহাওয়া অধিদপ্তর থাকলে বজ্রপাত সংক্রান্ত আগাম সতর্ক বার্তা সবাই জানতে পারতো। এটা হলে প্রাণহানিসহ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কম হতো।
বজ্রপাত সুনামগঞ্জে কেন বেশি হয়? : শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর প্রায় আশি ভাগ সুনামগঞ্জে ঘটে। বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয়বাষ্পপূর্ণ বায়ু সুনামগঞ্জের উপরে এসে মেঘালয় পর্বতে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়। যে বায়ুতে উষ্ণতা (তাপমাত্রা) বেশি থাকে। ওই গরম বায়ুতে সংঘর্ষ হওয়ায় আলোর বিস্ফোরণ ঘটে এবং বজ্রপাত হয়।
তিনি বলেন, সূর্য আমাদের যে তাপ (গরম) দিচ্ছে সেটা ফিরে যাওয়ার জায়গা পাচ্ছে না। সেই তাপমাত্রা মূলত পৃথিবীর উপরে থাকা ওজন স্তরে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি করছে। তাপমাত্রা বেশি হলে জলীয়বাষ্প কিংবা বায়ু দূষণও বেশি হয়। যা বৃষ্টিপাতকে প্রভাবিত করে। একসময় পুরো বর্ষাকাল জুড়েই বৃষ্টি হতো। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন সেটা হচ্ছে না। মূলত তাপমাত্রা বৃদ্ধিই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিক সমস্যা।

অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম আরও বলেন, সুনামগঞ্জের হাওরে গত ত্রিশ বছরে প্রায় ষাট ভাগ ভূমির ব্যবহারে পরিবর্তন এসেছে। অপরিকল্পিত হাওর রক্ষা বাঁধ, রাস্তাঘাট, অতিরিক্ত নদী শাসনে জলাধার কমে যাওয়ার মতো নেতিবাচক কর্মকান্ড জলবায়ু পরিবর্তনকে উৎসাহিত করছে। যে কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে বজ্রপাত বাড়ছে। তিনি বলেন, পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে বজ্রপাত হবে। এটা রাতারাতি পরিবর্তন করা যাবে না। এ জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতি-নির্ধারক, গবেষকসহ সকলকে সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। বজ্রপাতের সম্ভাব্য সময়ে গাছের নিচে থাকা যাবে না। এ সময় ক্ষেতে-মাঠে কাজ করা লোকজন যেন নিরাপদ আশ্রয়ে থাকে সেই সচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি। তাতে প্রায় আশি ভাগ মৃত্যুঝুঁকি কমানো সম্ভব।

নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha

কমেন্ট বক্স